বন্ধু নির্বাচনে ইসলামের ৫ নির্দেশনা/5 Islamic guidelines for choosing friends
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির। জীবন চলার পথে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বন্ধু হয়ে যায়। বন্ধুত্ব ছাড়া চলাও যায় না। তাই জীবনে উন্নতি করতে ভালো বন্ধুর প্রয়োজন অনেক অনেক বেশি। তাই তো ইসলাম বন্ধু নির্বাচনের নির্দেশনা দিয়েছে।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পবিত্র কোরআন ও রসুল সা-এর সুন্নাহই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। তাই ইসলামের বিধান মতো চললেই একজন মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের উপর থাকতে পারে। বন্ধু নির্বাচনে আল্লাহ তাআলা কোরআনে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ঈমানদার বন্ধু
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয়। মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয়, আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী। (সুরা আত তওবা ৭১)
অন্যদিকে বন্ধু নির্বাচনে মুমিন ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু না বানানোর জন্য জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেন রসুলুল্লাহ সা.। তিনি বলেন ‘মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে সঙ্গী নির্বাচন করবে না।’ (তিরমিজি ২৩৯৫)
অপরিচিতজনকে বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোনো ত্রুটি করবে না। যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই তাই তারা কামনা করে। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ থেকে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চেয়েও মারাত্মক। আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি।
যদি তোমরা অনুধাবন করো। তোমরা তাদেরকে ভালোবাসো; কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসেনা অথচ তোমরা সমস্ত আসমানি কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে বলে, আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতো বেশী বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে থাকে। তাদেরকে বলো, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন। তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের উপর কোনো বিপদ এলে তারা খুশি হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা বেষ্টন করে আছেন।’ (সুরা আলে ইমরান ১১৮-১২০)
মুসলিমদের প্রতি কেউ যদি হিংসা-বিদ্বেষ গোপন রাখে, ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে, মুসলিমদের ক্ষতি করা পছন্দ করে, যে কোনো উপায়ে তারা মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয়ার পরিকল্পনা যারা করে, তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন। যে, মুসলিমগণ অমুসলিমদের প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস রাখে তারা তাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করে। তাদেরকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে। এজন্য এ ধরণের মানুষকে বন্ধু বানানো যাবে না।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রা. আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ওমর রা. কে বললাম, আমার একজন খ্রিষ্টান সেক্রেটারি রয়েছে। তিনি বললেন, তোমার কী হলো? আল্লাহ তোমার অকল্যাণ করুন! তুমি কি আল্লাহর এ কথা শোন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! ইয়াহুদি ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অবশ্যই আল্লাহ জালেমদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা মায়েদা ৫১)
কোরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ (সুরা আলে ইমরান ২৮)
সত্যবাদী বন্ধু
যে কাউকে বন্ধু বলা যায় না, বন্ধু বানানো যায় না। সত্যবাদী, নামাজি, দীনদার ও পরোপকারী ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করা উচিত। এ জন্য কোরআনে বন্ধু নির্বাচনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে অবচেতন করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহাফ ২৮)
বন্ধু নির্বাচনে কেমন ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে-এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তাওবা ১১৯)
হযরত ইমাম গাজালি রহ. বলেছেন, যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। তা হলো, বুদ্ধিমত্তা ও সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া এবং পাপাচারী, বেদআতি ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া। হজরত ইমাম জাফর আস-সাদিক রহ. মুসলিম মিল্লাতকে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক করে বলেছেন, পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তা হলো-মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি। বন্ধু মনোনয়নে হজরত আলী রা.-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, নির্বোধের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। (দিওয়ানে আলী)
পরোপকারীকে বন্ধু বানানো
ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয়। তার ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় কেননা এ ধরনের বন্ধু ভুলত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। বিশেষ করে সে পরোপকারী হয়।
হযরত আলী রা. বলেছেন, ‘বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারও কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হচ্ছে অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদেও বন্ধুত্ব অটুট রাখা। লোকমান হাকিম বলেছেন, ‘প্রয়োজনের মুহূর্ত ছাড়া বন্ধুকে চেনা যায় না।’ একজন ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কোনো ধরনের স্বার্থ কিংবা প্রাপ্তির চিন্তা মাথায় না রাখা। সে বন্ধু অবশ্যই পরোপকারীকে বন্ধু হবে।
নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব
হযরত রসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলো, তো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসলো, কাউকে ঘৃণা করলো তো আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করলো, কাউকে কিছু দিলো তো আল্লাহর জন্যই দিল। কাউকে দেয়া বন্ধ করলো তো আল্লাহর জন্যই দেয়া বন্ধ করলো, তবে সে তার ঈমানকে পূর্ণ করলো।’ (মিশকাত শরিফ) নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আল্লাহর জন্যই হবে। দুনিয়ার কোনো স্বার্থের জন্য নয়। তাছাড়া শুধু আল্লাহর জন্য নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার রয়েছে। কিয়ামতের দিন যারা আল্লাহর জন্য একে অপর কে ভালোবাসবে, নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব করবে, আল্লাহ আরশের ছায়ার নিচে তাদের অবস্থান করাবেন। (তিরমিজি: ২৩৯১, বোখারি: ৬৬০, মুসলিম: ১০৩১, নাসায়ি: ৫৩৮০, মুসনাদে আহমাদ: ৯৩৭৩, মুওয়াত্তা মালিক: ১৭৭৭, ইবনু হিব্বান: ৪৪৮৬)
এ ছোট্ট জীবনে বন্ধুত্ব যদি করতেই হয়, তাহলে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বন্ধুত্ব তৈরি করা উচিত। ঈমানদার, সত্যবাদী ও পরোপকারীকে শুধু আল্লাহর জন্য বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য উত্তম প্রতিদান রেখেছেন। তাছাড়াও বন্ধুত্ব দুনিয়াতেও উপকারে আসে, সৎ, বুদ্ধিমান, মেধাবী, ধৈর্যশীল, চরিত্রবান, ধার্মিক, সুন্দর মনের অধিকারী, পরোপকারী ও নিরলস একজন ভালো বন্ধুই পারে পাল্টে দিতে আপনার জীবন। আমাদের বন্ধুত্বগুলো হোক আল্লাহর জন্যই।
রচনায়ঃমুফতি আবদুল্লাহ তামিম।তথ্যসূত্রঃসময়মিডিয়া
Post a Comment